বিশ্বের সবচেয়ে কৃপণ নারী

কালো জরাজীর্ণ জোব্বা পরা এক নারী প্রায়ই স্থানীয় বেকারি থেকে ভাঙা বিস্কুট কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এগুলোর দাম ছিল খুবই কম। তা ছাড়া ফ্রি হিসেবে কুকুরটার জন্য একটা হাড় পাওয়া যায়। বাজার থেকে তিনি প্রতিটি জিনিস কিনতেন খুব দামাদামি করে। বরফজমা ঠাণ্ডায়ও হিটার চালাতেন না, এমনকি ব্যবহার করতেন না গরম পানিও। কাপড়ের বেশি ময়লা অংশটুকু কচলে ধুয়ে ফেলতেন সাবানের খরচ বাঁচাতে। একদিন তাঁর ছেলে পড়ে গিয়ে হাঁটুতে আঘাত পেল। বিনা খরচে চিকিৎসা করানোর
জন্য তাকে নিয়ে গেলেন দরিদ্রদের হাসপাতালে। কিন্তু আঘাতটা ছিল গুরুতর। তাই তাকে পরে ভালো ডাক্তারের কাছে নিতেই হলো। কিন্তু দেরি করায় শেষ পর্যন্ত ছেলেটির পা কেটে ফেলতে হয়। এই গল্পগুলো দরিদ্র কোনো অসহায় নারীর নয়, বরং আঠারো শতকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী নারী হ্যাটি গ্রিনের। অনেকেই তাঁকে বর্ণনা করেছেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে কৃপণ নারী’ হিসেবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখা প্রথম নারী হিসেবেও তিনি স্মরণীয়।

মর্নিং শোজ দ্য ডে
হ্যাটির জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের নিউ বেডফোর্ড শহরে। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৩৪ সালের ২১ নভেম্বর। বাবা ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী। মা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। তাই দুই বছর বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে তাঁর কর্মক্ষেত্রে যেতেন হ্যাটি। বাবার কাছ থেকেই ব্যবসা শেখেন তিনি। ছয় বছর বয়সে তাঁর কাজ ছিল বাবাকে অর্থনীতির খবরের কাগজগুলো পড়ে শোনানো। এ বয়সেই নিজের নামে ব্যাংক হিসাব খোলেন তিনি। ১৩ বছর বয়সেই পারিবারিক ব্যবসার হিসাবরক্ষকের দায়িত্ব নেন। ১৫ বছর বয়সে পড়াশোনা করতে চলে যান বোস্টনে।

ব্যবসাবুদ্ধি
হ্যাটির ২১ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। মেয়ের জন্য তিনি রেখে গিয়েছিলেন সাড়ে সাত মিলিয়ন ডলার। পরিবারের অন্যদের বিরোধিতা সত্ত্বেও এই অতুল সম্পদ আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় ওয়ার বন্ডে বিনিয়োগ করেন হ্যাটি এবং পরে বন্ডগুলো বিক্রি করে তুলে নেন প্রচুর মুনাফা। এক হিসাবে তাঁর ব্যবসানীতি ছিল খুবই সাধারণ। যখন কোনো শেয়ারের বা পণ্যের চাহিদা থাকত না, কেউ সেখানে বিনিয়োগ করতে চাইত না, তিনি সেখানে টাকা খাটাতেন এবং সময়-সুযোগমতো তুলে নিতেন চড়া লাভ। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করে মোটা অঙ্কের লাভ করেন হ্যাটি। তবে বিষয়টি শুনতে যত সহজ মনে হচ্ছে, কার্যক্ষেত্রে মোটেই তত সহজ ছিল না। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রতিটি ডলার অতি সতর্কভাবে বিনিয়োগ করতেন তিনি।
মোটা সুদের বিনিময়ে অন্য ব্যবসায়ীদের টাকা ধারও দিতেন হ্যাটি। তবে টাকা ধার দেওয়ার আগে তাঁদের বিষয়ে সব তথ্য সংগ্রহ করতেন। আর ধার দেওয়ার শর্তগুলো সব সময়ই থাকত খুব কঠিন। ধারের টাকা যত কমই হোক না কেন, ফেরত পেতে দেরি হলে একাই বেরিয়ে পড়তেন টাকা আদায়ে। আর এ জন্য একা একা শত মাইলের বেশি পথও পাড়ি দিতেন তিনি।

বিবাহিত ও পারিবারিক জীবন
হ্যাটি ৩৩ বছর বয়সে বিয়ে করেন এডওয়ার্ড হেনরি গ্রিনকে। এডওয়ার্ড নিজেও ছিলেন বিত্তশালী। বিয়ে করার আগে এডওয়ার্ডকে ঘোষণা দিতে বাধ্য করেন, স্ত্রীর সম্পদের ওপর তাঁর কোনো অধিকার থাকবে না। বিয়ের পর এডওয়ার্ডের বাড়িতেই ওঠেন। তবে শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের সঙ্গে মোটেও বনত না। সারাক্ষণই ঝগড়া লেগে থাকত। এমনকি কাজের লোক, প্রতিবেশী আর দোকানদারদের সঙ্গেও ঝগড়া হতো।
পেশায় ব্যাংকার এডওয়ার্ড ঘটনাক্রমে তাঁর সব সম্পদ হারান। কিন্তু দুর্দিনে স্বামীর পাশে দাঁড়াননি হ্যাটি। বরং নিজের সম্পদ আলাদা করে অন্য জায়গায় বিনিয়োগ করেন। এই ঘটনার পর স্ত্রীকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যান এডওয়ার্ড। অবশ্য পরে তাঁরা একধরনের সমঝোতায় পেঁৗছেছিলেন। অ্যান ও নেড নামের দুটি সন্তান ছিল এই দম্পতির। অ্যানের বিয়ে নিয়েও কম ঘোঁট পাকাননি হ্যাটি। ভালো ভালো প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন তিনি। তাঁর ধারণা ছিল, শুধু মায়ের সম্পত্তির লোভেই অ্যানকে বিয়ে করতে চায় সবাই। অবশেষে ম্যাথু অ্যাস্টর উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদের ওপর অধিকার ছেড়ে দেওয়ার পরই অ্যানকে বিয়ে করতে সক্ষম হন। হ্যাটির মৃত্যুর পর অ্যান নিজের সম্পদ দিয়ে একটি হাসপাতাল গড়ে তোলেন।

মিথ্যা মামলা
হ্যাটির কৃপণতা আর নীচতার আরেকটি উদাহরণ এই ঘটনা। ফুফু সিলভিয়া উইলে নিজের ২০ লাখ ডলারের বেশির ভাগই দান করে গিয়েছিলেন। এই উইলের বিরোধিতা করে মামলা করেন হ্যাটি। কোর্টে আরেকটি উইল উপস্থাপন করেন তিনি, যাতে লেখা ছিল, ফুফু সব সম্পদ দিয়ে গেছেন তাঁকে। সেই সঙ্গে উইলে আরো বলা ছিল, এই উইলের পর আর কোনো উইলের বৈধতা থাকবে না। মামলাটিতে স্বাভাবিকভাবেই হেরে যান হ্যাটি। আদালত রায় দেন, হ্যাটি উইলে ফুফুর স্বাক্ষর জাল করেছেন। এই ঘটনায় অভিযুক্ত হলে আমেরিকা থেকে পালিয়ে লন্ডনে বহুদিন বসবাস করেছেন হ্যাটি গ্রিন।

ওয়াল স্ট্রিটের ডাইনি
হ্যাটিকে অনেকে ডাকতেন ‘উইচ অব ওয়াল স্ট্রিট’ বা ‘ওয়াল স্ট্রিটের ডাইনি’ বলে। নামটা দেওয়া হয়েছিল শেয়ার ব্যবসায় তাঁর দূরদর্শিতার জন্য। অনেকের মতে, পোশাকের জন্য তাঁর এই নাম দেওয়া হয়েছিল। বিখ্যাত এই কৃপণ নারীর বাইরে পরার পোশাক ছিল মাত্র দুটি। দুটিরই রং ছিল কালো আর বহু ব্যবহারে এগুলো ছিল একেবারেই জীর্ণ। পোশাক, ঝগড়াটে স্বভাব আর ব্যবসাবুদ্ধি মিলে এই নামকরণ সার্থক বলতেই হবে।

মানসিক অসুস্থতা
একধরনের মানসিক অসুস্থতা ছিল হ্যাটি গ্রিনের। তিনি মনে করতেন, সবাই কেবল তাঁর ক্ষতিই করতে চায়। একদিন তিনি রাস্তায় হাঁটার সময় কাছাকাছি একটা কাঠের খুঁটি পড়ে গেল। হ্যাটি নিশ্চিত ছিলেন যে এটা তাঁকে হত্যার জন্যই ফেলা হয়েছে। এভাবে প্রতিটি অঘটনেই ষড়যন্ত্র খুঁজে পেতেন তিনি। পৃথিবীর সবাই যেহেতু তাঁর ক্ষতি করতে চায়, তাঁকে ঘৃণা করে, ফলে অন্তর থেকে সবাইকে ঘৃণা করতেন হ্যাটি গ্রিন। তবে ব্যক্তি হিসেবে তিনি যেমনই হোন না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বিনিয়োগকারী হিসেবে তাঁর খুবই ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। যদিও তিনি সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, কিন্তু তাঁর ধার দেওয়া টাকায়ই পরিচালিত হয়েছে অনেক উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ড। যখন কোথাও টাকা পাওয়া যেত না, কেবল হ্যাটির কাছেই পাওয়া যেত। তাঁর কাছে তাই ঋণগ্রহীতাদের দরবার লেগেই থাকত। যদিও হ্যাটি নিজের লাভের জন্যই তাঁদের টাকা ধার দিতেন। সে সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তাঁর ভূমিকা স্বীকার করেন অর্থনীতিবিদরাও। সে কারণেই হ্যাটি গ্রিনকে শুধু কৃপণতার জন্য মনে রাখলে মস্ত বড় অন্যায়ই হবে।

0 comments:

Blogger Gadgets